Go to full page →

দাসানুদাস CCh 320

শিষ্যগণ যখন উপরিস্থ কুঠুরীতে সমবেত হইয়াছিলেন, তখন তাঁহাদের হৃদয় বিদ্বেষে পূর্ণ ছিল । যিহূদা খ্রীষ্টের বামপার্শ্বে একেবারে খ্রীষ্টকে ঘেঁষিয়া বসিয়াছিল ; যোহন তাঁহার দক্ষিণ পার্শ্বে ছিলেন । যিহূদা সর্ব্বদা উচ্চপদের আকাঙ্ক্ষী ছিল, আর সে মনে করিত খ্রীষ্টের পরেই সেই পদ । কিন্তু সে বিশ্বাসঘাতক ছিল । CCh 320.1

বিবাদের আরেকটী কারণ দেখা দিল । প্রথা ছিল, ভোজের সময় দাসেরা অতিথিগণের পা ধুইয়া দিবে, আর এই সময় এই অনুষ্ঠানের জন্য সকলই প্রস্তুত ছিল । পাদ-প্রক্ষালনের জন্য জলের কলসী, বোল ও গামছা প্রস্তুত ছিল ; কিন্তু কোন দাস তথায় উপস্থিত ছিল না, এই জন্য শিষ্যগণেরই করণীয় ছিল, দাসের অংশ গ্রহণ করা । কিন্তু শিষ্যগণের প্রত্যেকেই অহঙ্কারে স্ফীত হইয়া দাসের কার্য্য করিতে দৃঢ়ভাবে অসম্মত রহিলেন । তাঁহাদের যে কি করিতে হইবে, তদ্বিষয়ে তাঁহারা সকলেই এই বিষয়ে কৃত্রিম উদাসীনতা দেখাইলেন । তাঁহাদের নীরবতা দ্বারা তাঁহারা নিজেদিগকে অবনত করিতে অস্বীকার করিলেন । CCh 320.2

পরস্পরের পাদ-প্রক্ষালনের জন্য শিষ্যগণ অগ্রসর হইলেন না । তাঁহারা কি করেন, তাহা দেখিবার নিমিত্ত খ্রীষ্ট কিয়ৎকাল অপেক্ষা করিলেন । পরে তিনি—ঐশ্বরিক গুরু,—মেজ হইতে উঠিলেন । তাঁহার গতিগমনে বিঘ্ন ঘটাইতে পারে বলিয়া তিনি তাঁহার উপরের বস্র খুলিয়া রাখিলেন, এবং একখানি গামছা লইয়া কটিবন্ধন করিলেন । শিষ্যগণ বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া রহিলেন এবং ইহার পরে কি ঘটে, তাহা দেখিবার নিমিত্ত নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন । “পরে তিনি পাত্রে জল ঢালিলেন ও শিষ্যদের পা ধুইয়া দিতে লাগিলেন ; এবং যে গামছা দ্বারা কটিবন্ধন করিয়াছিলেন, তাহা দিয়া মুছাইয়া দিতে লাগিলেন ।” ইহাতে শিষ্যগণের নয়ন উম্মুক্ত হইল । তীব্র লজজায় ও নম্রতায় তাঁহাদের হৃদয় পূর্ণ হইয়া গেল । তাঁহারা অব্যক্ত ভর্ৎসনা বুঝিতে পারিলেন, এবং এই নূতন দীপ্তির সাহায্যে নিজেদের অবস্থা সম্পূর্ণরূপে দেখিতে পাইলেন । CCh 320.3

এইরূপে খ্রীষ্ট শিষ্যগণের প্রতি তাঁহার প্রেম প্রদর্শন করিলেন । তাঁহাদের স্বার্থপরতা তাঁহাকে দুঃখে নিমগ্ন করিল, কিন্তু তাঁহাদের অসুবিধা সম্বন্ধে তিনি তাঁহাদের সহিত কোন বাদ-প্রতিবাদ না করিয়া, তাঁহাদিগকে এমন একটী দৃষ্টান্ত দেখাইলেন, যাহা কস্মিনকালেও ভুলিবার নহে । তাঁহাদের প্রতি তাঁহার নিঃস্বার্থ প্রেম সহজে বিচলিত কিংবা নির্ব্বাপিত হইবার ছিলনা । তিনি জানিতেন যে, পিতা সমস্তই তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন ও তিনি ঈশ্বরের নিকট হইতে আসিয়াছেন, আর ঈশ্বরের নিকটে যাইতেছেন । তাঁহার ঈশ্বরত্ব তাঁহার পূর্ণ জ্ঞান ছিল ; তথাপি তিনি রাজমুকুট ও রাজবস্ত্র ত্যাগ করিয়া দাসের রূপ ধারণ করিলেন । পৃথিবীতে তাঁহার শেষ কার্য্যকলাপের মধ্যে একটী কার্য্য ছিল, দাসের রূপ ধারণ করা ও দাসের কার্য্য করা । CCh 321.1

খ্রীষ্ট স্বীয় শিষ্যগণকে বুঝাইতে চাহিয়াছিলেন যে, যদিও তিনি তাঁহাদের পদ ধৌত করিয়াছিলেন, তথাপি এতদ্দ্বারা তাঁহার মর্য্যাদার বিন্দু-মাত্রও হানি হয় নাই । “তোমরা আমাকে গুরু ও প্রভু বলিয়া সম্বোধন করিয়া থাক ; আর তাহা ভালই বল কেননা আমি সেই ।” এত অসীম শ্রেষ্ঠ হইলেও এই পাদ-প্রক্ষালন কার্য্যে তিনি তাঁহার মধুরতা ও গুরুত্ব প্রদর্শন করিয়াছিলেন । খ্রীষ্টের মত এত উচ্চপদান্বিত কেহই ছিল না । তথাপি সর্ব্বাপেক্ষা নীচ ও বিনীত কার্য্য করিবার নিমিত্ত তিনি আপনাকে অবনত করিলেন । স্বাভাবিক হৃদয়ে যে স্বার্থপরতা বিরাজ করে, তাঁহার প্রজাগণ যেন তদ্দ্বারা বিপথগামী হইয়া আত্মসেবায় রত না থাকে, তজজন্য খ্রীষ্ট স্বয়ং নম্রতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছিলেন । উক্ত মহান্ বিষয়টীর ভার তিনি মনুষ্যের হস্তে গচ্ছিত রাখেন নাই । এই বিষয়টী তাঁহার নিকটে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ঈশ্বরের সহিত এক থাকা সত্ত্বেও তিনি স্বয়ং শিষ্যগণের প্রতি দাসের কার্য্য করিয়াছিলেন । সর্ব্বোচ্চ পদের জন্য যখন তাঁহারা বিবাদ করিতেছিলেন, তখন প্রতাপান্নিত দূতগণ সসম্মানে যাঁহার পূজা করা গৌরবের বিষয় মনে করেন এবং যাঁহার নিকট প্রত্যেক জানু পাতিতে হইবে, সেই খ্রীষ্ট নতজানু হইয়া যাঁহারা তাঁহাকে প্রভু বলিয়া সম্বোধন করিতেন, তাঁহাদেরই পদ প্রক্ষালন করিয়াছিলেন । যে তাঁহাকে শত্রু হস্তে সমর্পণ করিয়াছিল, তিনি সেই বিশ্বাসঘাতকেরও পদ ধৌত করিয়াছিলেন । CCh 321.2

শিষ্যগণের পাদপ্রক্ষালন করিয়া তিনি কহিলেন, “আমি তোমাদিগকে দৃষ্টান্ত দেখাইলাম, যেন তোমাদের প্রতি আমি যেমন করিয়াছি, তোমরাও তদ্রূপ কর ।” (যোহন ১৩:১৫ ।) এই কথাগুলি দ্বারা খ্রীষ্ট যে কেবল অতিথি সেবার আদেশ দিয়াছিলেন এমন নহে । যাত্রাপথে অতিথিগণের পদপ্রান্তে যে ধুলা সংলগ্ন হয়, তাহা ধৌত করা অপেক্ষাও এতদ্দ্বারা অধিকতর কিছু বুঝায় । খ্রীষ্ট এই স্থানে একটী ধর্ম্মানুষ্ঠান স্থাপন করিতেছিলেন । আমাদের প্রভুর কার্য্য দ্বারা এই নম্রতার অনুষ্ঠানটী দত্ত হইয়াছিল । CCh 322.1