সিরিয়ার আন্তিয়খিয়া, যেখানে পৌল ও বার্ণবাকে প্রথম পরিচর্যা কাজে পাঠানো হয়, সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁরা আগেই বিশ্বাসীদেরকে একত্রিত করলেন এবং “ঈশ্বর তাঁহাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া যে কত কার্য করিয়াছিলেন ও তিনি যে পরজাতীয়দের নিমিত্তে বিশ্বাস—দ্বার খুলিয়া দিয়াছিলেন, সেই সকল বর্ণনা করিলেন।” প্রেরিত ১৪:২৭। আন্তিয়খিয়ার মন্ডলীটি ছিল বেশ বড় ও ক্রমবর্ধমান। পরিচর্যা কাজের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এখানে খ্রীষ্টিয়ান বিশ্বাসীদের বেশ বড় একটি দল ছিল। এই মন্ডলীটি যিহূদী ও পরজাতীয় উভয় প্রকার মানুষের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। AABen 153.1
প্রেরিতগণ যখন আন্তিয়খিয়ায় খ্রীষ্টের জন্য বহু আত্মাকে জয় করার মানসে মন্ডলীর পরিচর্যাকারী ও সাধারণ সদস্যদের সাথে মিলিত হলেন তখন ফরীশী দলের পাঠানো যিহূদিয়ার কয়েকজন বিশ্বাসী তাদের মধ্যে এমন একটি প্রশেড়বর অবতারণা ঘটালেন যে, তা খুব দ্রুত মন্ডলীতে বিশ্বাসী পরজাতীয়দের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিল। যিহূদী মতাদর্শী এই বিশ্বাসীরা খুব জোর দিয়ে বলতে লাগলেন যে, পরিত্রাণ পেতে হলে একজন বিশ্বাসীকে অবশ্যই ত্বকচ্ছেদ করাতে হবে এবং সমস্ত যিহূদী আনুষ্ঠানিক রীতিনীতি যথাযথভাবে পালন করতে হবে। AABen 153.2
পৌল এবং বার্ণবা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এই মিথ্যা ধারণার মুখোমুখি হলেন এবং তারা পরজাতীয়দেরকে এই বিষয়টি বিপক্ষে বললেন। অন্যদিকে আন্তিয়খিয়ার বিশ্বাসী যিহূদীদের মধ্যে অনেকেই যিহূদিয়া থেকে আগত ভাইদের সাথে একমত হয়েছিলেন। AABen 153.3
যিহূদী ধর্ম থেকে আগত বিশ্বাসীরা খুব সহজে তাদের প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতা ও রীতিনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইত না। পরজাতীয়দের AABen 153.4
______________________________________«
এই অধ্যায়টি প্রেরিত ১৫:১—৩৫ পদের উপর ভিত্তি করে রচিত
______________________________________« মধ্যে প্রেরিতদ্বয়ের পরিচর্যা কাজের ফলে এটি স্পষ্টভাবে বোঝা গিয়েছিল যে, যিহূদী ধর্ম থেকে আগত বিশ্বাসীদের চেয়ে পরজাতীয় বিশ্বাসীরা সংখ্যাগতভাবে অনেক বেশি ছিল। যিহূদীরা ভয় পাচ্ছিল যে, যদি পরজাতীয়দের মন্ডলীতে সহভাগিতা গ্রহণের জন্য আনুষ্ঠানিক রীতিনীতি ও বাধানিষেধ কার্যকর করা না হয় তাহলে যিহূদীরা এক সময় সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে এবং অবশেষে সুসমাচার প্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে তারা একেবারেই অদৃশ্য হয়ে পড়বে।
যিহূদীরা ঈশ্বর কর্তৃক মনোনীত জাতি হিসেবে সব সময়ই নিজেদেরকে নিয়ে গর্ব করত এবং খ্রীষ্টের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করলেও মন থেকে এই ধারণা মুছে ফেলতে পারেনি যে, ঈশ্বর একবার ইব্রীয় যে পদ্ধতিতে উপাসনা করতে শিখিয়েছেন তা তিনি কখনো পরিবর্তন করতে বা বাতিল করতে পারেন না। এর ফলে তারা এই বক্তব্য জোরদারভাবে উপস্থাপন করেছিল যে, খ্রীষ্ট ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে যিহূদীদের বিধি বিধান ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা উচিত। তারা এ কথা সহজে বুঝতে চাইছিলেন না যে, সমস্ত বলি উৎসর্গের রীতি নীতি ছিল ঈশ্বরের পুত্রের প্রতীকী রীতি। আর তাই প্রতীক যখন মূলরূপের দেখা পেল, তখন মোশীর আইন কানুনের আর কোন প্রযোজ্যতা বা বাধ্যবাধকতা থাকল না। আলোচনা শুরু করার আগে পৌল নিজেকে “ব্যবস্থাগত ধার্মিকতা স¤¦ন্ধে অনিন্দনীয়” বলে উল্লেখ করলেন। ফিলিপীয় ৩:৬। কিন্তু মন পরিবর্তনের পর থেকে তিনি স্পষ্টভাবে এই ধারণা পেলেন যে, ত্রাণকর্তার উদ্দেশ্য সমগ্র মানব জাতিকে, তথা যিহূদী ও পরজাতীয়দেরকে সমানভাবে পরিত্রাণ দেওয়া এবং তিনি জীবন্ত বিশ্বাসের সাথে বাস করা এবং মৃত ও অসার আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বাস করার পার্থক্যও শিখেছে। সুসমাচারের আলোকে ইস্রায়েলর প্রাচীন রীতি নীতি ও আইন কানুন তাঁর কাছে নতুন ও গভীর তাৎপর্য পেয়েছে। এই সমস্ত রীতিনীতি ও আইন কানুন যার ছায়া হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছিল তা সম্পনড়ব হওয়ার পর এখন আর বিশ্বাসীরা সেই সকল আইন কানুনের বাধ্যবাধ্যকতার অধীনে নেই। তবে পৌল তাঁর চিঠিতে এ কথা লিখেছেন যে, ঈশ্বরের অপরিবর্তনীয় আইন দশ আজ্ঞা পৌল চিরকালের জন্য তাঁর চেতনায় ধরে রেখেছেন। AABen 154.1
আন্তিয়খিয়া মন্ডলীতে ত্বকছেদ নিয়ে যে প্রশ্নব উঠেছিল তা প্রচুর আলোচনা ও মতবিরোধের জন্ম দিয়েছিল। অবশেষে মন্ডলীর সদস্যরা যখন এই ভয় পেলেন যে মন্ডলীতে এই আলোচনার কারণে বিভক্তি দেখা দিতে পারে তখন তারা পৌল ও বার্ণবাকে মন্ডলীর কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে যিরূশালেমে পাঠিয়ে দিলেন যেন তারা এই বিষয়টি প্রেরিত ও প্রাচীনদের সামনে উপস্থাপন করেন। সেখানে তারা বিভিন্ন মন্ডলীতে আগত প্রতিনিধিদের দেখা পেলেন যারা যিরূশালেমে আসনড়ব উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন। এর মধ্যে সাধারণ পরিষদ থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগ পর্যন্ত সমস্ত আলোচনা ও বিতর্ক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে সেটি সারা দেশের সমস্ত মন্ডলীগুলোতে সার্বজনীনভাবে গ্রহণ করে নেওয়া হবে বলে ঠিক করা হল। AABen 154.2
যিরূশালেমে যাওয়ার পথে প্রেরিতগণ যে সমস্ত শহরের মধ্যে দিয়ে গেলেন সেসব শহরে বসবাসকারী বিশ্বাসীদের সাথে দেখা করলেন এবং ঈশ্বরের পরিচর্যা কাজে নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং পরজাতীয়দের মন পরিবর্তনের কথা জানিয়ে তাদেরকে উৎসাহ দিলেন। AABen 155.1
যিরূশালেমে আন্তিয়খিয়া থেকে আগত প্রতিনিধিদল যিরূশালেমে ধর্মীয় উৎসবে যোগদানের জন্য আসা বিভিন্ন মন্ডলীর ভাইদের সাথে দেখা করলেন এবং তারা পরজাতীয়দের মধ্যে পরিচর্যা কাজে যে সাফল্য পেয়েছেন সে কথা তাদেরকে জানালেন। এরপর কয়েকজন বিশ্বাসী ফরীশী আন্তিয়খিয়ায় গিয়ে যে বিতর্কটি শুরু করেছেন সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিয়ে বললেন যে, যিহূদীদের মতে পরজাতীয় বিশ্বাসীদের পরিত্রাণ পেতে হলে অবশ্যই ত্বকছেদ করাতে হবে এবং মোশীর আইন মান্য করতে হবে। AABen 155.2
পরিষদে এই বিষয়টি নিয়ে বেশ আন্তরিকভাবে আলোচনা করা হল। ত্বকছেদ নিয়ে প্রশ্নব ওঠার পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে প্রশ্নব উঠল। উদ্ভুত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি ছিল প্রতিমার কাছে নিবেদিত খাবার খাওয়া নিয়ে। পরজাতীয় বিশ্বাসীদের মধ্যে অনেকেই অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছনড়ব লোকদের মধ্যে বসবাস করত যারা প্রতিমার কাছে বলি ও উৎসর্গ দিত। পরজাতীয়দের যাজকরা এই বিশ্বাসীদের কাছে পূজায় নিবেদিত খাবার বিক্রি করত। এতে করে যিহূদীরা এই ভয় পাচ্ছিল যে, পরজাতীয় বিশ্বাসীরা প্রতিমার কাছে উৎসর্গকৃত খাবার খাওয়ার মাধ্যমে খ্রীষ্ট ধর্মের অবমাননা করবে এবং পৌত্তলিকদের রীতি নীতি অনুসরণ করতে শুরু করবে। AABen 155.3
আবার পরজাতীয়েরা গলা টিপে মারা পশুর মাংস খেতে অভ্যস্ত ছিল, অন্যদিকে যিহূদীদেরকে ঈশ্বর আদেশ দিয়েছিলেন যেন তারা যখন খাবার জন্য পশু হত্যা করবে তখন যেন অবশ্যই লক্ষ্য রাখে যেন শরীর থেকে সমস্ত রক্ত বেরিয়ে যায়; নতুবা সেই মাংস খাবার যোগ্য হবে না। ঈশ্বর যিহূদীদেরকে এই নির্দেশনা দিয়েছিলেন যেন তারা যে খাবার খাবে তা স্বাস্থ্যসম্মত হয়। যিহূদীরা খাবার হিসেবে রক্ত গ্রহণ করাকে পাপ হিসেবে গণ্য করত। তারা সাব্যস্ত করেছিল যে, রক্ত হচ্ছে জীবন সে কারণে রক্তপাত করা পাপ হিসেবে বর্তায়। AABen 155.4
অপরদিকে পরজাতীয়দের নিয়ম ছিল উৎসর্গের বলিকৃত প্রাণীর রক্ত ধরে রেখে সেটি খাবার তৈরির প্রস্তুতিমূলক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা। যিহূদীরা কখনো ভাবতে পারেনি যে, ঈশ্বরের বিশেষ নির্দেশনার অধীনে তারা যে রীতি নীতিতে অভ্যস্ত হয়েছে সেটি কখনো পরিবর্তন হবে। এ কারণে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যে, যিহূদী ও পরজাতীয়েরা এক টেবিলে খেতে বসলে প্রথম পক্ষ সব সময়ই দ্বিতীয় পক্ষের কার্যকলাপে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত। AABen 156.1
পরজাতীয়েরা, বিশেষত গ্রীকরা অতি মাত্রায় উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করত বলে সেখানে এই ভয় ছিল যে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো অন্তরে পরিবর্তিত না হওয়ায় খ্রীষ্টের প্রতি বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করলেও তাদের পুরাতন ধ্যান ধারণা ও মন্দ অভ্যাস পরিবর্তন করবে না। যিহূদী খ্রীষ্টিয়ানরা এই অনৈতিকতা মোটেও বরদাস্ত করত না, যা পরজাতীয়দের কাছে অন্যায় বলে গণ্যই হত না। এ কারণে যিহূদীরা শিরোধার্য বলে সাব্যস্ত করেছিল যে, পরজাতীয় বিশ্বাসীদের আন্তরিকতা ও ভক্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তাদের অবশ্যই ত্বকছেদ করাতে হবে এবং মোশীর আইন কানুন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতে হবে। তারা ভেবেছিল যে, এর ফলে এমন লোকের আগমন বন্ধ হবে যারা অন্তরের প্রকৃত পরিবর্তন না এনেই মণ্ডলীতে বিশ্বাসী হিসেবে যোগ দিচ্ছে এবং যাদের অনৈতিক ও অসংলগ্ন কার্যকলাপের কারণে মণ্ডলীর অবমাননা হতে পারে। AABen 156.2
পরিষদের সামনে নিষ্পত্তির জন্য যে প্রশ্নটি আনা হয়েছিল তার সাথে হাজারো বিষয় যুক্ত থাকায় সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পবিত্র আত্মা ইতোমধ্যেই প্রশ্নটির উপযুক্ত উত্তর ঠিক করে রেখেছিলেন, যার ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত মূলত খ্রীষ্টিয় মণ্ডলীর বিস্তৃতির উপর নির্ভর করে নেওয়া হয়েছিল। AABen 156.3
“আর অনেক বাদানুবাদ হইলে পিতর উঠিয়া তাঁহাদিগকে বলিলেন, ‘হে ভ্রাতৃগণ, তোমরা জান, ইহার অনেক দিন পূর্বে ঈশ্বর তোমাদের মধ্যে আমাকে মনোনীত করিয়াছিলেন, যেন আমার মুখে পরজাতীয়েরা সুসমাচারের বাক্য শুনিয়া বিশ্বাস করে।’” তিনি এই যুক্তি দেখালেন যে, পবিত্র আত্মা অছিন্নত্বক পরজাতীয় ও ছিন্নত্বক যিহূদীদেরকে মণ্ডলীতে সমান ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি তাঁর দর্শনটির কথা স্মরণ করলেন যেখানে ঈশ্বর তাঁর সামনে একটি চাদর ভর্তি করে সব ধরনের চারপেয়ে প্রাণী এনেছিলেন এবং সেগুলোকে ধরে ধরে তাকে খেতে বলেছিলেন। তিনি যখন এসব প্রাণী খেতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং বললেন যে, তিনি কখনো এসব কোন অশুচি প্রাণী খাননি, তখন তাঁকে এই জবাব দেওয়া হল, “ঈশ্বর যাহা শুচি করিয়াছেন, তুমি তাহা অপবিত্র বলিও না।” প্রেরিত ১০:১৫। AABen 157.1
পিতর এই কথার শেষে যুক্ত করলেন যে, এই দর্শন দেখার পরই তাঁকে শতপতির সাথে দেখা করে তাকে খ্রীষ্টের বিশ্বাস সম্পর্কে শিক্ষা দানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।এই বার্তা প্রকাশ করে যে, ঈশ্বর কোন মানুষের মুখাপেক্ষা করেন না, বরং যারা তাঁকে ভয় করে তাদের সকলকে তিনি গ্রহণ করেন ও স্বীকৃতি দেন। পিতর তাঁর বিস্ময়ের কথা এভাবে প্রকাশ করলেন যে, যখন তিনি কর্ণীলিয়ের গৃহে উপস্থিত সকলের কাছে সত্যের বাক্য প্রচার করছিলেন তখন তিনি দেখেছিলেন কীভাবে পবিত্র আত্মা সেখানে উপস্থিত প্রত্যেকের উপরে নেমে এসেছিল, পরজাতীয় ও যিহূদী প্রত্যেকের উপরেই। ছিন্নত্বক যিহূদীদের উপরে ঈশ্বরের যে মহিমার জ্যোতি এসে পড়েছিল সেই একই জ্যোতি পতিত হয়েছিল অছিন্নত্বক পরজাতীয়দের উপরেও। ঈশ্বর সতর্ক করে দিয়েছিলেন যেন তাদের মধ্যে কাউকে অন্যের চেয়ে ছোট করে না দেখেন, কারণ খ্রীষ্টের রক্ত প্রত্যেকটি মানুষকেই অশুচিতা থেকে মুক্ত করার জন্য সেচিত হয়েছিল। AABen 157.2
কর্ণীলিয় ও তাঁর সঙ্গীদের মন পরিবর্তন এবং তাদের সাথে পিতরের সহভাগিতা নিয়ে এর আগেও একবার তিনি তাঁর বিশ্বাসী ভাইদেরকে আশ্বস্ত করেছেন। পবিত্র আত্মা কীভাবে পরজাতীয়দের উপরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সে বিষয়টিকে উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “অতএব, তাহারা প্রভু যীশু খ্রীষ্টে বিশ্বাসী হইলে পর, যেমন আমাদিগকে, তেমনি যখন তাঁহাদিগকেও ঈশ্বর সমান বর দান করিলেন, তখন আমি কে যে, ঈশ্বরকে নিবারণ করিতে পারি?” প্রেরিত ১১:১৭। এখন আবারও তিনি সমান উৎসাহ ও জোর নিয়ে বলেছেন: “ঈশ্বর, যিনি অন্তঃকরণ জানেন, তিনি তাহাদের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়াছেন, আমাদিগকে যেমন, তেমনি তাহাদিগকেও পবিত্র আত্মা দান করিয়াছেন; এবং আমাদের ও তাহাদের মধ্যে কোন পার্থক্য রাখেন নাই, বিশ্বাস দ্বারাই তাহাদের চিত্ত শুচি করিয়াছেন। অতএব এখন তোমরা কেন ঈশ্বরের পরীক্ষা করিতেছ, শিষ্যগণের স্কন্ধে সেই জোয়ালি দিতেছ, যাহার ভার না আমাদের পিতৃপুরুষেরা, না আমরা বহন করিতে সমর্থ হইয়াছি?” এই যোয়ালি মোটেও দশ আজ্ঞা নয়, যা অনেকে ভুল বুঝে থাকেন; কিন্তু পিতর এখানে যিহূদীদের আনুষ্ঠানিকতার বিধি বিধানের কথা বলেছেন, যেগুলো খ্রীষ্টের ক্রুশারোপণের পর মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। AABen 157.3
পিতরের এই বক্তব্যের পরে সমবেত সকলে শান্ত হলেন এবং এতে পৌল ও বার্ণবার কথা বলার মত পরিবেশ তৈরি হল, যাঁরা পরজাতীয়তের কাছে তাদের পরিচর্যা কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন। “তখন সমস্ত লোক নীরব হইয়া রহিল; আর বার্ণবার ও পৌলের দ্বারা পরজাতিগণের মধ্যে ঈশ্বর কি কি চিহ্নকার্য ও অদ্ভুত লক্ষণ সাধন করিয়াছেন, তাঁহাদের কাছে তাহার বৃত্তান্ত শ্রবণ করিল।” AABen 158.1
যাকোবও তাঁর সাক্ষ্য দিলেন এবং সিদ্ধান্ত জানিয়ে ঘোষণা করলেন যে, ঈশ্বরের একান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে পরজাতীয়রা যেন যিহূদীদের মতই সমান অধিকার ও আশীর্বাদ পায়। AABen 158.2
পবিত্র আত্মা পরজাতীয় বিশ্বাসীদের উপরে আনুষ্ঠানিক রীতি নীতি চাপিয়ে না দেওয়াটাই ভাল করে মনে করেছিলেন এবং প্রেরিতরাও তাঁদের অন্তরে ঈশ্বরের আত্মার এই ইচ্ছা জ্ঞাত হলেন। যাকোব এই সভার সভাপতিত্ব করছিলেন এবং তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল এই, “অতএব আমার বিচার এই, পরজাতিগণের মধ্যে যাহারা ঈশ্বরের প্রতি ফিরে, তাহাদিগকে আমরা কষ্ট দিব না।” AABen 158.3
এর মধ্য দিয়ে সমস্ত বিতর্কের অবসান ঘটল। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রোমান ক্যাথলিক মণ্ডলীর এই দৃঢ় বিশ্বাসটি ভ্রান্ত বলে প্রমাণ হয় যে, পিতর মণ্ডলীর প্রধান ছিলেন। পোপ হিসেবে যারা তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদেরকে দাবী করেন তাদের এই দাবীর পেছনে পবিত্র শাস্ত্রের কোন প্রমাণ নেই। পিতরের জীবন থেকেও এমন কোন কিছু প্রমাণ হয় না যে, তাঁকে তাঁর ভাইদের থেকে উঁচু অবস্থানে নিয়ে মহামান্য বা আত্মিক পিতার উপাধি দেওয়া হয়েছিল। যারা নিজেদেরকে পিতরের উত্তরসূরী হিসেবে ঘোষণা দেন তাদেরকেও তাঁরই মত করে বিশ্বাসী ভাইদের সাথে সমতায় জীবন যাপন করতে হবে। AABen 158.4
এই ঘটনায় আমরা দেখি যাকোবকে পরিষদে সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। তাঁরই বিচারের রায় হিসেবে আনুষ্ঠানিক রীতি নীতি, বিশেষ করে ত্বকছেদের বিধানটি পরজাতীয়দের উপরে কার্যকর করা বা এমনকি তাদেরকে তা করতে পরামর্শ দেওয়ার কথাও নিষেধ করা হয়েছে। যাকোব তাঁর বিশ্বাসী ভাইদেরকে এ কথা বিশেষভাবে বোঝাতে চেয়েছেন যে, ঈশ্বরের দিকে মন ফেরানোর মধ্য দিয়ে পরজাতীয়দের জীবনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে এবং সে কারণেই যথেষ্ট সাবধান হওয়া দরকার যেন কোন অপ্রয়োজনীয় বা মূল্যহীন বিষয় নিয়ে তর্ক তুলে তাদেরকে আরও জটিলতার মধ্যে ফেলা বা প্রশ্নবিদ্ধ করা না হয়, পাছে তারা খ্রীষ্টকে অনুসরণ করতে বিঘ্ন পায়। AABen 159.1
তবে পরজাতীয় বিশ্বাসীদেরকে খ্রীষ্টের প্রতি বিশ্বাসের সাথে যায় না এমন সমস্ত রীতি নীতি ও অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। প্রেরিতগণ ও প্রাচীনগণ এ বিষয়ে একমত হন যে, পরজাতীয় বিশ্বাসীদেরকে চিঠির মাধ্যমে নির্দেশ দেওয়া হবে যেন প্রতিমার কাছে উৎসর্গীকৃত খাবার না খান, ব্যভিচার না করেন, গলা টিপে মারা প্রাণী না খান এবং রক্ত না পান করেন। তাদেরকে খ্রীষ্টের সমস্ত আজ্ঞা অনুসারে পবিত্র জীবন যাপন করতে উৎসাহ দেওয়া হবে। তাদেরকে এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, যে সমস্ত লোক ত্বকছেদ করা বাধ্যতামূলক বলে প্রচার করছে তারা প্রেরিতদের কাছ থেকে ক্ষমতা পেয়ে এ কাজ করছে না। AABen 159.2
পৌল ও বার্ণবাকে পরজাতীয়দের কাছে এমন আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে যারা প্রভুর পক্ষে তাদের জীবন বিপন্ন করেছেন। যিহূদা ও সীলকে এই দুই প্রেরিতের সাথে প্রেরণ করা হল যেন তারা নিজেদের মুখে পরজাতীয়দের কাছে পরিষদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান: “পবিত্র আত্মার এবং আমাদের ইহা বিহিত বোধ হইল, যেন এই কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া তোমাদের উপরে আর কোন ভার না দিই। ফলে প্রতিমার প্রসাদ এবং রক্ত ও গলা টিপিয়া মারা প্রাণীর মাংস ও ব্যভিচার হইতে পৃথক থাকা তোমাদের উচিত; এই সকল হইতে আপনাদিগকে সযত্নে রক্ষা করিলে তোমাদের কুশল হইবে।” ঈশ্বরের এই চার সেবককে এই চিঠি ও বার্তা দিয়ে আন্তিয়খিয়ায় পাঠানো হল যেন তারা সমস্ত বিতর্কের অবসান ঘটান; কারণ এটিই ছিল পৃথিবীতে ঈশ্বরের পক্ষে সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। AABen 159.3
যে পরিষদ এই বিচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তাতে ছিলেন প্রেরিতগণ ও শিক্ষকগণ যারা যিহূদী ও পরজাতীয় খ্রীষ্টিয় মণ্ডলীগুলো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। যিরূশালেমের প্রাচীনগণ, আন্তিয়খিয়া থেকে আগত অধ্যক্ষগণ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী মণ্ডলীগুলোর প্রতিনিধিগণ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সুষ্ঠু বিচার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে পরিষদ সামনে এগিয়ে গেছে এবং এর মধ্য দিয়ে মণ্ডলীতে ঐশ্বরিক অবস্থানও তার মর্যাদায় অটুট ছিল। একটি ঐক্যমতে পৌছানোর ফলে তারা সকলে দেখতে পেলেন ঈশ্বর স্বয়ং এই দ্বন্দ্বের উত্তর দান করেছেন পরজাতীয়দের উপরে পবিত্র আত্মার অবতরণের মধ্য দিয়ে; আর এতে তাঁরা আরও উপলব্ধি করলেন যে, এখন তাদের দায়িত্ব পরজাতীয়দেরকে পবিত্র আত্মার নির্দেশনা অনুসারে চলতে উৎসাহিত করা। AABen 160.1
সমগ্র খ্রীষ্টিয়ান সমাজকে এই প্রশ্নের বিচারে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। “প্রেরিত ও প্রাচীনগণ,” যারা মণ্ডলীর বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন, তারাই এই বিষয়ে বিধান দিয়ে তা ধার্য করলেন এবং পরবর্তীতে সমস্ত খ্রীষ্টিয় ম—লীতে তা গৃহীত হয়। সকলেই যে এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হতে পেরেছিলেন তা নয়; কিছু আত্মরম্ভী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসী ভাই এই সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। এই ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের মত করে কাজ করার কথা চিন্তা করলেন। তারা আরও বেশি করে জল্পনা কল্পনা করে একে অন্যের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে লাগলেন এবং যাদেরকে ঈশ্বর সুসমাচারের সত্য প্রচারের জন্য মনোনীত করেছেন তাদের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত মণ্ডলীটি তার সূচনালগ্ন থেকেই এ ধরনের বাধার মুখোমুখি হয়ে আসছে এবং কালের শেষ পর্যন্ত এভাবেই খ্রীষ্টের মণ্ডলী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে। AABen 160.2
যিরূশালেম ছিল যিহূদীদের রাজধানী এবং এখানেই যিহূদীদের সবচেয়ে বেশি আত্মরম্ভিতা ও গোঁড়ামি দেখা যেত। যে সকল যিহূদী খ্রীষ্টিয়ানরা বিশেষত পবিত্র ধর্মধামের কাছাকাছি বাস করত তারা নিজেদেরকে যিহূদী জাতির একটি অংশ হিসেবে ভাবতেই ভালবাসত এবং যিহূদীদের বিশেষ অধিকারগুলো ভোগ করতে চাইত। তারা যখন দেখল খ্রীষ্টিয় মণ্ডলীগুলো যিহূদী ধর্মের আনুষ্ঠানিক রীতি নীতি বর্জন করছে, যা তারা দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে লালন করে আসছে, তখন অনেকেই পৌলের উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, কারণ তিনিই এই পরিবর্তনের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছেন। এমনকি শিষ্যদের মধ্যেও সকলে পরিষদের সিদ্ধান্ত আন্তরিকভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। অনেকেই আনুষ্ঠানিক আইন কানুন পালনের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন এবং তারা পৌলের উপরে অসন্তুষ্ট হলেন, কারণ তারা ভাবছিলেন যিহূদী রীতি নীতির উপরে যে নিষেধাজ্ঞা ধার্য করা হয়েছে তার আদৌ কোন ভিত্তি নেই। AABen 160.3
পরিষদের এই ব্যাপৃত ও সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তের কারণে পরজাতীয় বিশ্বাসীদের মনে দারুনভাবে স্বস্তি ও আস্থা ফিরে এল এবং ঈশ্বরের পরিকল্পনা আরও দ্রুত বাস্তবায়িত হতে শুরু করল। আন্তিয়খিয়া মণ্ডলীর যিহূদা ও সীলের উপস্থিতিতে আশীর্বাদপ্রাপ্ত হল, যারা যিরূশালেম থেকে প্রেরিতদেরকে নিয়ে বিশেষ ঘোষণা সহ এসেছিলেন। “আপনারাও ভাববাদী ছিলেন বলিয়া,” যিহূদা ও সীল “অনেক কথা দ্বারা ভ্রাতৃগণকে আশ্বাস দিলেন ও সুস্থির করিলেন।” ঈশ্বরভক্ত এই ব্যক্তিরা কিছু দিন আন্তিয়খিয়ায় অবস্থান করলেন। “পৌল ও বার্ণবা আন্তিয়খিয়াতে অবস্থিতি করিলেন, তাঁহারা অন্য অন্য অনেক লোকের সহিত প্রভুর বাক্য লইয়া শিক্ষা দিতেন ও সুসমাচার প্রচার করিতেন।” AABen 161.1
পরবর্তীতে পিতর যখন আন্তিয়খিয়ায় পরিদর্শনে যান তখন পরজাতীয়দের মন পরিবর্তনের ব্যাপারে তাঁর বিজ্ঞ বক্তব্যের কারণে তিনি অনেকের কাছেই সাদরে গৃহীত হন। তিনি প্রথমে ঐশ্বরিক নির্দেশনা অনুসারেই পথ চলেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তাঁর স্বভাবগত ধ্যান ধারণা ত্যাগ করে অবশেষে পরজাতীয়দের সাথে বসেছেন। তবে যখন আনুষ্ঠানিক রীতি নীতির প্রতি আগ্রহী কিছু যিহূদী যিরূশালেম থেকে আসলেন তখন পিতর অপ্রত্যাশিতভাবে পরজাতীয়দের মন পরিবর্তনের ব্যাপারে তার মত পরিবর্তন করেন। এ ব্যাপারে বলা হয়েছে: “তাঁহার সহিত অন্য সকল যিহূদীও কপট ব্যবহার করিল; এমন কি, বার্ণবাও তাঁহাদের কাপট্যের টানে আকর্ষিত হইলেন।” বিশ্বাসীদের কাছে যারা এতটা সম্মানের পাত্র তাদের এই দুর্বলতার প্রকাশ ঘটায় পরজাতীয় বিশ্বাসীদের অন্তরে প্রবল দুঃখবোধ জেগে উঠল। মণ্ডলী প্রায় বিভক্ত হওয়ার উপক্রম হল। কিন্তু পৌল যখন দেখলেন যে, পিতরের দ্বিমুখী আচরণের কারণেই মণ্ডলীর উপরে এই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তখন তিনি পিতরকে তার প্রকৃত মনোভাব লুকিয়ে মনগড়া মত প্রকাশের জন্য জনসমক্ষে ভর্ৎসনা করলেন। মণ্ডলীর সামনেই পৌল পিতরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি নিজে যিহূদী হইয়া যদি যিহূদীদের মত নয়, কিন্তু পরজাতিগণের মত আচরণ কর, তবে কেন পরজাতিগণকে যিহূদীদের মত আচরণ করিতে বাধ্য করিতেছ?” গালাতীয় ২:১৩, ১৪। AABen 161.2
পিতর যে ভুল করেছিলেন তা বুঝতে পারলেন এবং যে ক্ষতি ইতোমধ্যে সাধিত হয়েছে তা ঠিক করার জন্য তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর ক্ষমতা অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ঈশ্বর, যিনি সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই জানেন, তিনিই পিতরকে তাঁর দুর্বলতা প্রকাশ করতে দিলেন যেন বিচারে দোষী সাব্যস্ত প্রেরিত এ কথা উপলব্ধি করতে পারেন যে, তাঁর ভেতরে নিজস্ব এমন কিছুই নেই যার জন্য তিনি গর্ব করতে পারেন। এমনকি সবচেয়ে ভাল মানুষটিও নিজের বুদ্ধি অনুসারে চলতে গেলে অবশ্যই ভুল করবেই। ঈশ্বর আরও দেখলেন যে, এমন এক সময় আসবে যখন কোন কোন লোক নিজেদেরকে পিতরের উত্তরসূরী হিসেবে দাবী করে নিজেদেরকে এমন উচ্চ অবস্থানে নিয়ে দাঁড় করাবে যা একমাত্র ঈশ্বরই পাওয়ার দাবী রাখেন। উপরন্তু প্রেরিতের দুর্বলতার এই নির্দশনটি প্রমাণ বহন করে যে, তিনি মোটেও নির্ভুল নন এবং তিনি মোটেও অন্য প্রেরিতদের চেয়ে উঁচু অবস্থানে ছিলেন না। AABen 162.1
ন্যায্যতা থেকে বিচ্যুত হওয়ার এই ঘটনাটি ঈশ্বরের পক্ষে কার্যকারী সমস্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে সতর্ক করে দেয় যেন তারা কোনভাবে তাদের সততা ও বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত না হন, বরং দৃঢ়ভাবে তাদের নীতিতে অটল থাকেন। মানবীয় এই প্রতিনিধিদের উপরে যত বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তত বেশি তার শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে, তত বেশি তিনি ক্ষতি সাধন করতে পারেন যদি তিনি প্রভুর নির্ধারিত পথ অনুসরণ না করেন এবং বিশ্বাসের সম্মিলিত পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজ না করেন। AABen 162.2
পিতরের সমস্ত ব্যর্থতার পর; তাঁর পতন ও প্রত্যাবর্তন, তাঁর দীর্ঘ পরিচর্যার জীবন, খ্রীষ্টের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব, ন্যায্যতার নীতি সম্পর্কে ত্রাণকর্তার সোজাসাপ্টা চিন্তা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান নিহিত থাকা সত্ত্বেও; তিনি যে সমস্ত নির্দেশনা লাভ করেছেন, বাক্য প্রচার ও শিক্ষা দানের মধ্য দিয়ে তিনি যে সকল দান ও জ্ঞান ও প্রভাব অর্জন করেছেন তার পরেও — এতে কি আমাদের অবাক লাগে না যে, মানুষের ভয়ে বা জনপ্রিয়তা আদায়ের জন্য তিনি সুসমাচারের সত্যকে এভাবে অস্বীকার করলেন? এটা কি অবাক হওয়ার মত নয় যে, তাঁর অধিকারবলে নিজ মতাদর্শে স্থির থাকা তাঁর উচিত ছিল? ঈশ্বর যেন প্রত্যেকটি মানুষকে তার নিজ অসহায়ত্ব এবং তার চিন্তাধারাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে অসমর্থতা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি দেন। AABen 162.3
পৌল তাঁর পরিচর্যা কাজে কখনো কখনো একাকী বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন। তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে বিশেষভাবে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং নীতির প্রশ্নে তিনি কখনো কোনভাবেই টলেননি। কোন কোন সময় পৌলের উপরে অনেক বেশি বোঝা এসে পড়েছে বটে, কিন্তু তিনি সব সময় ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান করেছেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, মণ্ডলীকে কখনোই মানবীয় কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণে যেতে দেওয়া যাবে না। মানবীয় প্রথা ও ধ্যান ধারণাকে কখনোই প্রকাশিত সত্যের স্থান নিতে দেওয়া যাবে না। সুসমাচারের অগ্রযাত্রাকে কখনোই কোন মানুষের পক্ষপাতিত্ব ও পছন্দের কারণে ব্যাহত হতে দেওয়া যাবে না, সে মণ্ডলীতে যে বড় অবস্থানেই থাকুক না কেন। AABen 163.1
পৌল নিজেকে ও তাঁর সমস্ত শক্তিকে ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদন করেছিলেন। তিনি সরাসরি স্বর্গ থেকে সুসমাচারের সত্য জেনেছিলেন এবং তাঁর সমগ্র পরিচর্যা কাজ জুড়ে তিনি স্বর্গীয় সত্তার সাথে চমৎকারভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে গেছেন। স্বয়ং ঈশ্বর তাঁকে পরজাতীয় খ্রীষ্টিয়ানদের উপরে অযথা ভার অর্পণ করতে নিষেধ করেছেন; এ কারণেই আন্তিয়খিয়া মণ্ডলীতে যিহূদী খ্রীষ্ঠিয়ানরা যখন ত্বকছেদ করানোর প্রসঙ্গ তুললেন তখনই পৌল জানতেন এ ধরনের প্রসঙ্গ সম্পর্কে ঈশ্বরের আত্মার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন এবং সেজন্য তিনি মণ্ডলীকে এ ধরনের যিহূদী রীতি নীতি থেকে মুক্ত করার জন্য অটল অবস্থান নিয়েছিলেন। AABen 163.2
পৌল সরাসরি ঈশ্বর কর্তৃক শিক্ষা লাভ করা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত দায়িত্বের ব্যাপারে তাঁর ধারণায় কোন ঘাটতি ছিল না। প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বরের নির্দেশনার জন্য প্রত্যাশা করলেও মণ্ডলীর সহভাগিতায় বিশ্বাসীদের মাঝে ঈশ্বর যে কর্তৃত্ব দিয়েছেন তা গ্রহণ করার জন্যতিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন। তিনিও পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন এবং যখন কোন গুরুত্বপূণ বিষয় সামনে আসত তখন তিনি আনন্দের সাথেই মণ্ডলীর সামনে বিষয়টি উপস্থাপন করে বিশ্বাসী ভাইদের সাথে একত্রে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন, যেন তিনি তাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেন। এমনকি “ভাববাদীদের আত্মা,” তিনি ঘোষণা করেছেন, “ভাববাদীদের বশে আছে; কেননা ঈশ্বর গোলযোগের ঈশ্বর নহেন, কিন্তু শান্তির।” ১ করিন্থীয় ১৪:৩২, ৩৩। পিতরকেও তিনি শিখিয়েছেন যে, মণ্ডলীর অন্তর্গত প্রত্যেক সদস্যকে “এক জন অন্যের সেবার্থে নম্রতায় কটিবন্ধন”করতে হবে। ১ পিতর ৫:৫। AABen 163.3